বাংলাদেশে ৯০ এর দশকে ভ্যাট চালুর যে পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল তা বর্তমানে দেশের রাজস্ব আয়ের অন্যতম বড় একটি উৎস এবং বলা হয় যে, মূসক চালুর সিদ্ধান্ত দেশের অর্থনীতির জন্য যুগান্তকারী পদক্ষেপ ছিল।
চলতি অর্থ বছরের মার্চ মাস পর্যন্ত মূসক আদায় করা হয়েছে ৮৬ হাজার ৫২৩ কোটি টাকা।
গত ২০২১-২২ অর্থবছরে মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট থেকে রাজস্ব আয় হয়েছে ১ লাখ ৮ হাজার ৪১৮ কোটি ২৩ লাখ টাকা। সেবছর মোট রাজস্ব আদায় হয়েছিল ৩ লাখ এক হাজার ৬৩৩কোটি টাকা।
অর্থাৎ দেশের মোট আদায়কৃত রাজস্বের মধ্যে প্রায় এক তৃতীয়াংশই মূসক থেকে আদায় হওয়া অর্থ।
এরআগে ২০২০-২১ অর্থবছরে ৯৭ হাজার ৫০৯ কোটি টাকার ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ক আদায় হয়েছিল।
তবে অভিযোগ আছে, বাংলাদেশে ব্যবসায়ীরা ক্রেতাদের কাছ থেকে মূসক আদায় করলেও অনেকেই তা সরকারি কোষাগারে জমা করেন না।
ভ্যাট বা মূল্য সংযোজন কর বা মূসক হচ্ছে একটি পরোক্ষ কর।
সহজ ভাবে বলা যায় যে, কোন ক্রেতা যখন কোন পণ্য বা সেবা ক্রয় করেন, তার মূল্যের অতিরিক্ত যে কর তিনি দিয়ে থাকেন, সেটাই হচ্ছে ভ্যাট বা মূসক।
কোন পণ্য বা সেবার সর্বশেষ ভোক্তা বা ক্রেতাই সেই পণ্য বা সেবার মূসক দাতা। আর এই মূসক সরকারি কোষাগারে জমা দেয়ার দায়িত্ব বিক্রেতার।
উনিশ’শ একানব্বই সালের পহেলা জুলাই থেকে মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট বা মূসক চালু করা হয়। প্রথমে অল্প কিছু পণ্যের উপর মূসক আরোপ করা হয়েছিল। পর্যায়ক্রমে অধিকাংশ পণ্য এবং বেশ কিছু সেবা-পরিষেবা, আমদানী, পাইকারী ও খুচরা বিক্রয়কৃত পণ্যের মূসক আরোপ করা হয়। বর্তমানে এটি সরকারের রাজস্ব আয়ের অন্যতম বড় একটি উৎস।
মূসক আইন অনুযায়ী, সব ধরণের করযোগ্য আমদানি এবং করযোগ্য সরবরাহের উপর মূসক আরোপিত হয়। বাংলাদেশে পণ্য বা সেবার উপর ১৫ শতাংশ হারে মূসক আরোপের নিয়ম রয়েছে। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেড় শতাংশ থেকে শুরু করে ১০ শতাংশ হারেও মূসক নির্ধারণ করা হয়ে থাকে।
যেভাবে ভ্যাটের যাত্রা শুরু
নিউইয়র্ক ভিত্তিক ফাইনান্সিয়াল মিডিয়া ওয়েবসাইট ইনভেস্টোপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে ভ্যাট বা মূসকের যাত্রা শুরু মূলত ইউরোপে। ফ্রান্সের কর কর্তৃপক্ষ ১৯৫৪ সালে প্রথম দেশ হিসেবে মূসক আরোপ করে। তবে এর প্রায় এক শতাব্দী আগে জার্মানিতে পণ্যের সাপ্লাই চেইনের প্রতিটি ধাপে কর দেয়ার রীতি প্রচলিত ছিল বলেও জানা যায়।
শিল্পোন্নত দেশগুলোর সংস্থা অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন এন্ড ডেভেলপমেন্টের বেশিরভাগ সদস্য দেশেই ভ্যাট ব্যবস্থা চালু ছিল।
বাংলাদেশে ভ্যাট বা মূসক চালুর তোড়জোর শুরু হয় ১৯৮৯ সালের দিকে হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদের শাসনামলে। তখন অর্থমন্ত্রী ছিলেন অধ্যাপক ড. ওয়াহিদুল হক।
সেসময় ভ্যাট চালু প্রক্রিয়ার সাথে যারা সরাসরি যুক্ত ছিলেন তাদের মধ্যে একজন অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর। তিনি তখন আন্তর্জাতিক মুদ্রা সংস্থার ফিসক্যাল অ্যাফেয়ার্স ডিপার্টমেন্টে যারা কর নীতি এবং সরকারের ব্যয় নিয়ে কাজ করে সেই বিভাগের সিনিয়র ইকোনমিস্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন।
মি. মনসুর বলেন, ১৯৮৮ সালে দেশ জুড়ে প্রলয়ংকারী বন্যার পর, দেশের রাজস্ব ব্যবস্থার উন্নয়নের জন্য কারিগরি সহায়তা দিতে আইএমএফকে আহ্বান জানিয়েছিলেন তৎকালীন অর্থমন্ত্রী অধ্যাপক ড. ওয়াহিদুল হক।
তার অনুরোধে রাজি হয় আইএমএফ। এর অংশ হিসেবে আইএমএফ এর একটি প্রতিনিধিদল ১৯৮৯ সালে বাংলাদেশ সফর করে।
তৎকালীন অর্থমন্ত্রী ড. ওয়াহিদুল হকের অনুরোধে সেই প্রতিনিধিদলে ছিলেন মি. মনসুর।
তিনি বলেন, সেসময় আইএমএফ থেকে তাকে বলে দেয়া হয়েছিল যে, ভ্যাট ব্যবস্থা বাংলাদেশে চালু করা যায় কিনা সেটা নিয়ে ভাবা এবং সম্ভব হলে সেটি চালু করা।
“সেভাবেই আমি এখানে আসি,” বলেন তিনি।
আইএমএফ-এর এমন উদ্যোগের কারণ হিসেবে মি. মনসুর বলেন, সেসময় বাংলাদেশের জাতীয় আয়ের তুলনায় রাজস্ব আয় অনেক কম ছিল। সেটাকে বাড়ানোটা একটা লক্ষ্য ছিল। একই সাথে ভ্যাট তখন বিশ্বজুড়ে পরিক্ষীত এবং সফল একটি ব্যবস্থা ছিল। বিশ্বের প্রায় ৭০-৮০টি দেশে এই ব্যবস্থা চালু ছিল। যার কারণে বাংলাদেশেও একই ধরণের ব্যবস্থা চালুর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল।
আইএমএফ এর প্রতিনিধিদল বাংলাদেশে এসে সরকারের সাথে কাজ শুরু করে এবং এর অংশ হিসেবে ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, ভারত ও ফিলিপিন্সের মতো ভ্যাট চালু রয়েছে এমন কয়েকটি এশিয় দেশ সফর করে।
সফর শেষে বাংলাদেশের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের কাছে একটি প্রতিবেদন জমা দেয়া হয়।
“এতে সুপারিশ করা হয় যে, এখানে ভ্যাট চালু করা সম্ভব এবং আমরা করতে চাই,” বলেন তিনি।
এই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ভ্যাট চালু করার বিষয়ক পরবর্তী কার্যকলাপ শুরু হয়।
অর্থনীতিবিদ মি. মনসুর বলেন, ভ্যাট চালু করা নিয়ে ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের সাথে আলোচনা শুরুর পর তারা এর বিরোধিতা করে। এমনকি দেশের জনগণও এটা শুরুতে মানতে চায়নি।
এর প্রতিবাদ জানিয়ে তারা সেসময় এনবিআর বা জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ভবন বেশ কয়েক বার ঘেরাও পর্যন্ত করেছিল।
“দশ-বিশ হাজার মানুষ এসে এনবিআর ঘেরাও করে ‘ভ্যাট চলবে না’ ইত্যাদি স্লোগান দেয়।”
মি. মনসুর বলেন, “অনেক রকমের প্রতিবন্ধকতা ছিল। এটা স্বাভাবিক। এটা থাকে, এটা নতুন কিছু নয়।”
তবে ভ্যাট চালু করার বিষয়ে তৎকালীন সরকার ইচ্ছুক ছিল বলে কাজ চলতে থাকে। রাজস্ব বোর্ডও তখন এ বিষয়ে ব্যাপক সহায়তা দিয়েছিল। সব মিলিয়ে ১৯৯০ এর দিকে যখন ভ্যাট চালু সংক্রান্ত আইন তৈরির জন্য পার্লামেন্টে তোলার প্রস্তুতি চলছিল তখন জেনারেল এরশাদের সরকার পতন হয়।
এমন অবস্থায় ১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসে। এই সরকারের রাষ্ট্রপতি হন বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদ।
পার্লামেন্ট না থাকার কারণে ভ্যাট সংক্রান্ত বিলটি তখন রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে অধ্যাদেশ হিসেবে জারির প্রস্তাব তোলা হয়।
অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর বলেন, তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদ এই প্রস্তাবে রাজি ছিলেন না। তার যুক্তি ছিল, তিনি অস্থায়ী সরকার প্রধান এবং তিন মাস পরেই ক্ষমতা থেকে সরে যাবেন। কিন্তু তিনি এই অধ্যাদেশ জারি করলে সেটি আইনে পরিণত হয়ে দীর্ঘদিন ধরে চলমান থাকবে।
“পরবর্তীতে আমরা তাকে বোঝাতে সক্ষম হই যে এটা আমাদের বাজেটের জন্য খুব দরকার। কেয়ারটেকার গভর্নমেন্ট ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে যদি এটা না করে তাহলে জুলাই মাসে বাজেটের এটা চালু করতে পারবো না। ফলে আমাদের রাজস্ব আয়ে বড় একটা লস হবে।”
মি. মনসুর বলেন, এমন যুক্তির পর তিনি অনিচ্ছা সত্ত্বেও এই আদেশে সই করেন এবং পরে এটি অধ্যাদেশে পরিণত হয়।
পরবর্তীতে বিএনপির নেতৃত্ত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর তৎকালীন অর্থমন্ত্রী এম সাইফুর রহমান ভ্যাট অধ্যাদেশকে আইনে পরিণত করে ১৯৯১ সালের জুলাই মাস থেকে এটি চালু করেন।