সারিবদ্ধ পিঁপড়াগুলো হেঁটে যাচ্ছে মেহেদির পায়ের বুড়ো আঙুলের পাশ ঘেঁষে। মাঝে মাঝে তারা চক্র তৈরি করে ঘুরতে থাকে। প্রায় এমন হয়। দূর থেকে দেখলে কখনো মনে হয়, ভীষণ সরু কোনও সাপ পাহারা দিচ্ছে যক্ষের ধন। মেহেদির তখন মনে হয়, তার মূল্যহীন জীবনে কী এমন গুপ্তধন লুকিয়ে আছে ?
ঘরের দিকে তাকালে কেবল একটি সিঙ্গেল খাট দেখা যায়। সাধারণ কাঠের। রাজকীয় চাকচিক্য নেই। তবে খোলা জানালা দিয়ে যেন জান্নাতের বাতাস বয়। মিতু আপা আসেন মাঝে মাঝে। আপা এলে গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে থাকেন। একটি, দুটো কথা বলেন। বাতাসে মিতু আপার চুল উড়তে থাকলে চোখ ঢাকা পড়ে যায়। তখন মেহেদি একটু পাশে সরে এসে ওনার দিকে দৃষ্টি ফেরায়। নাহ, ওড়না পাখির মতো উড়ে চলে যায় না। পিঁপড়ের দল আপার পায়ে অতর্কিত আক্রমন করে না, কিংবা সত্যি সত্যি সাপ এসে নৃত্যমান ফনাও তুলে না, যাতে মিতু আপা ভয় পেয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে অথবা এমন কিছু একটা করে, যাতে ওড়নাটা সরে যায়। মেহেদির মনে হয় সাক্ষাৎ বেহেশতের হুর সৌরভ ছড়ায় তার ছন্নছাড়া শোবার ঘরে; যে-সে কি আর অমন মাতাল করা গন্ধে জীবিত করতে পারে অন্তরের মোহর?
কেবলই কি সুবাস? এই তো ক’দিন আগে, মেহেদির ঘাড়ের কাছে আপা নিঃশ্বাস ফেলে বলেছিল, এবার একটু মানুষ হ।
আমি বুঝি মানুষ নই?
মানুষকে খেলতে জানতে হয়।
মিতু আপা উত্তর না নিয়ে চলে গিয়েছিলেন। অবশ্য কথা হারিয়ে ফেলেছিল মেহেদি। কিন্তু বুঝতে পেরেছিল, তার ঘরে নিষ্পাপ জগৎপ্রাণের ছোঁয়া লেগে আছে , মিতু আপাও আসলে পৃথিবীর কেউ নন। আর তাই কিছুটা বিরহে অভ্যাসের অন্যথা ঘটিয়ে সেদিন নিজের সঙ্গে খেলতে খেলতে দুপুরের পরিবর্তে ঘুমিয়েছিল বিকেল পর্যন্ত।
ট্রেনে বসে এসব ভাবনায় বিষণ্ন হয়ে ওঠে মেহেদি। দেখতে পায়, এখানেও পিঁপড়ের দল তার পিছু ছাড়েনি। আগের মতোই আশেপাশে দল বানিয়ে ঘোরাফেরা করছে। ট্রেনটিও থেমে আছে অচেনা জায়গায়।
চুপশব্দের নীরবতা দীর্ঘক্ষণ ধরে ভ্রমণে থাকা মেহেদির ক্লান্তি আরও বাড়িয়ে তোলে। তার মনে হয় জন্মের অনেক আগে থেকেই এই যাত্রা শুরু হয়েছে। যখন ভ্রুণ ছিল, তখন হয়তো নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল, মনোটনাস একটি জার্নি তাকে সম্পূর্ণ অদেখা জায়গায় এনে ফেলবে। অবশ্য মেহেদি জটিলভাবে চিন্তা করার মানুষ নয়। তাই পড়ন্ত বিকেলে রেলগাড়ির স্বেচ্ছা অথবা জোরপূর্বক বিশ্রামকালীন সময়ে আচমকা গ্রেগর সামসার সঙ্গে দেখা হয়ে গেলে সে প্রথমে তাকে চিনতে পারে না।
কেবল যে যন্ত্রদানব নিস্তেজ জীবের মতো ঘুমিয়ে আছে তা নয়; নিজের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে মেহেদি দেখতে পায়- সোনালী কাঁটাগুলো মৃত পাখির ডানার মতো গতিহীন। বিরক্তির পালে হাওয়া লাগে যখন গ্রেগর সামসা এসে বলে, কেমন আছেন? খেয়াল করেছেন, পুরো বগিতে মানুষ আমরা দুজন শুধু।
মেহেদি সিটে বসেছিল হেলান দিয়ে। লোকটিকে সে চিনছে না। লোকটির চেহারায়ও ঠিক বিস্ময়ের চিহ্ন নেই, যেন সে জানে এই বগিতে আসলে দুজনই থাকার কথা। পরক্ষণেই আবার নিজের ভাবনায় ডুবে যায়। সে ভাবে, চিরকাল আমোদ ফূর্তি করা মানুষ হয়েও মিতু আপার কথায় এভাবে হুট করে রাজি হয়ে যাওয়া উচিৎ হয় নি।
জীবনে কোনোদিন ময়মনসিংহের গন্ডি ছেড়ে বের হয় নি। মিতু আপা দিকশূন্যপুরের লোভ দেখালেন, এসাইনমেন্টের কথা বলে পাঠালেন এই ভুতূড়ে ট্রেনে। বললেন, ঘুরে আয় তোর সিদ্ধি হবে, ওখানে মেয়েরা ভারি সুন্দর, চাই কি দুই তিনজন পটিয়েও ফেলতে পারিস। মিতু আপাকে না পেলে অন্য কেউই সই; নাহয় মেহেদি কি চরপাড়া পার হয়ে মাসকান্দা যায়? আর মাসকান্দা গেলেই কি ঢাকার বাসে উঠে বসে? ঢাকার বাসে উঠে বসলেই কি কমলাপুর এসে ট্রেনে খোঁজে?
একবার মনে হয়েছিল, এই দিকশূন্যপুর ব্যাপারটা আবার কী? ভেবেছিল জানতে চাইবে। কিন্তু জীবনে প্রথম কি দ্বিতীয়বারের মতো মিতু আপা ঝুঁকে তার সামনে দাঁড়ালে সে সব ভুলে গিয়েছিল। মনে হয়েছিল, পৃথিবী গোল- এর চেয়ে ভুল সত্য শব্দ আর একটিও নেই। দিকশূন্যপুরেও নিশ্চিত এমন আরাধ্য কিছুই তার অপেক্ষায় আছে। এভাবেই শুরু হয়েছিল মেহেদির যাত্রা।
সামসা আততায়ীর মতো মেহেদির ভাবনার মাঝে ঢুকে পড়ে আবার। বলে, আমাকে চিনতে পেরেছেন, নিশ্চয়।
এবার মেহেদি একটু মনোযোগ দিয়ে তাকায়।
সাদা চামড়ার এই লোককে চেনার কারণ নেই তার। লোকটার মাথায় কাউবয় হ্যাট, অদ্ভুত একটা পোশাক পরনে- না মনে হয় পাঞ্জাবি, না মনে হয় জোব্বা। চোখ দুটি ছোট ছোট, হ্যাট থেকে একটা চুল বের হয়ে চোখের মাঝ বরাবর এসে ঝুলছে।
চিনতে পারছি না, সহজভাবেই উত্তর দেয় মেহেদি।
আমি গ্রেগর সামসা। বলতে বলতে লোকটি মেহেদির সামনের ফাঁকা সিটে নিজের শরীর ছেড়ে দিয়ে জুতো খুলে আঙুলগুলো উপরে-নিচে নড়াচড়া করে, আর বাদামের খোসা খোলার সময়ে যেমন মৃদু একটা খসখসে শব্দ শোনা যায়, তেমন শব্দে পিঁপড়ের সারি নিমিষে বৃষ্টিজলের মতো ধুঁয়ে যায়।
তারপরেও ভাবান্তর হয় না মেহেদির। লোকটির কথায় এমন কিছু প্রকাশ পাচ্ছে না, যাতে বোঝা যায় তিনি মেহেদির নাম জানেন। সুতরাং, মেহেদি ধরে নেয় আগন্তুক বিখ্যাত কেউ- যাকে সে চেনে না অথবা তিনি কেউই নন।
সামসা বলল, আপনাকে এই বিরল ট্রেনের যাত্রী নিশ্চয় এর পেছনে কোনও উদ্দেশ্য আছে। যে-সে তো চাইলেই এই ভ্রমণ ভাগ্য পায় না। আপনি গন্তব্য কোথায়?
অস্বস্তি বোধ করে মেহেদি। লোকটি একে বিদেশি, তার উপর কথা বলছে একেবারে প্রমিত বাংলায়। স্বাভাবিক ঘটনা অবশ্যই নয়। তাও গন্তব্য জানতে চাইছে। এই যাত্রার খবর কি গোপনীয় কিনা, সে মনে করতে পারে না।
নিজের চারপাশে তাকায় মেহেদি। সবমিলিয়ে ৬০টি সিট। সামসার কথা অনুযায়ি খেয়াল করে, পুরো বগিতে সত্যি তারা দুজন। ট্রেন যখন ছেড়ে দিয়েছিল, তখন অন্য মানুষ ছিল কিনা তাও স্মরণ করতে পারে না। একটু ভালোভাবে খেয়াল করতে চাইলে দেখে, ময়মনসিংহ ছেড়ে আসার পর ট্রেনে এতদূর পথ চলে আসা পর্যন্ত তেমন কোনও স্মৃতি তার মাথায় নেই।
ঘোলা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে চারপাশে সবুজ ব্যতীত আর কিছু দেখতে পায় না। দৃষ্টি সয়ে এলে বিস্ময়ে দেখে, সবুজ আসলে গাছপালা নয় বরং আকাশ-মাটি সবকিছুই সবুজ হয়ে আছে। এটাই কি তবে দিকশূন্যপুর? নিজের ব্যাগের দিকে তাকায় ও। সেখানে অ্যাসাইনমেন্টের কাগজ। খুলে দেখেনি বিস্তারিত। এখন মনে হচ্ছে, ভুল হয়েছে। তার উপর এই গ্রেগর সামসা মাথার উপর চাপ তৈরি করছে।
প্রথমবারের মতো সামসার প্রশ্নের উত্তর দেয়। সে বলে, ব্যাপারটি অস্বাভাবিক। এতটা নির্জনতা, মন বিবশ করা গোপনীয়তায় অচেনা আগুন্তুকের সঙ্গে কথোপকথনে আমি ঠিক অভ্যস্ত নই।
ওর দিকে তাকালে দেখতে পায়, হাতে চুরুট নিয়ে বসে আছে, আঙুলের ফাঁকে সেটি লেগে আছে। এই চুরুট হাতে ম্যারাডোনার ছবি দেখেছে সে। একবার ভাবে চাইবে। অনেকক্ষণ ধরে সিগারেটেও টান দেয়া হচ্ছে না।
চুরুটে দীর্ঘক্ষণ ধরে টান দেয় সামসা। ধোঁয়া জমতে থাকে গোল হয়ে। ঘুরতে ঘুরতে ঠিক যেন মেহেদির মাথার উপরে এসে মেঘের মতো জমে যায়। মেঘটি ধীরে ধীরে জান্তব পোকার আকার ধারণ করে। মনে হয়ে, একটা ছোট্ট হেলিকপ্টার ল্যান্ড করতে চাইছে তার মস্তিস্কের গভীরে।
যান্ত্রিক ডানার দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থাকে মেহেদি। তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার মনে হয়, লোকটিকে সে চিনতে পারছে, অনার্স জীবনের শুরুতে অনেকটা সময় এর সঙ্গে কাটানো হয়েছে। এমনকি বাড়িতে তার বালিশের নিচে রাখা বইয়ের ভেতর রক্ষিত আছে লোকটির যাবতীয় রহস্য ।
এখন, বুঝতে পেরেছেন, আমি কে?
মেহেদি ভাবে, এই তবে গ্রেগর সামসা?- কাফকার বিখ্যাত উপন্যাস মেটামরফসিসের সামসা? গল্পের শুরুতে যে সামসা নিজেকে আবিষ্কার করেছিল পোকা হিসেবে? এতক্ষণে পুরো বিষয়টা খানিক পরিষ্কার হয় তার কাছে।
মেহেদি বলে, অবাক হলাম । তাছাড়া এই আপনাকে চেনার প্রশ্নই আসে না। অমন বিকট, বিচ্ছিরি পোকা থেকে আবার সুদর্শন মানুষে রুপান্তরিত হলে চেনার সাধ্যটা কার?
হাসতে থাকে গল্পের চরিত্র-সামসা। হাসার সময় তার ছোট ছোট দাঁত দেখা যায়। একসময় যে পুরো শরীরটাই আস্ত এক বিভৎস পোকা ছিল তার চিহ্নমাত্র নেই। মেহেদি অবশ্য তারচেয়েও অবাক হয় নিজের কথা ভেবে। এই যে এতসব অস্বাভাবিক দৃশ্যের জন্ম হচ্ছে, অথচ সে কি দিব্যি কথা বলে যাচ্ছে, যেন এমনটাই হবার কথা ছিল দীর্ঘদিন ধরে।
সামসা বলে, একটু ধরিয়ে দিলে, আপনি যে আমাকে চিনতে পারবেন, জানতাম।
কিভাবে?
বোঝা যায়, আপনার সাহিত্যের প্রতি ঝোঁক আছে।
মেহেদি সায় জানায় মাথা ঝাঁকিয়ে।
সামসা বলতে থাকে, একজন সাধারণ গ্রেগর সামসাকে কেউ চিনত না। এখন সবাই জানে রুপান্তরিত সামসাকে। অথচ দেখেন, কি কষ্টের জীবনটাই না কাটিয়েছি। চোখের পলকে সব বদলে যায়। পোকা হয়ে যাবার পর বাবা-মা-বোন সবাই একসঙ্গে কত নিষ্ঠুরতম আচরণ করে আমার সঙ্গে। আর আজ যখন নিজেকে ফিরে পেয়েছি, এই ট্রেনে করে ঘুরে বেড়াচ্ছি কেউ আমাকে চিনতে পারছে না। মূল আমার, আসল আমার- কোনও অস্তিত্ব নেই কোথাও।
সামসা নিজ থেকেই চুরুটটি বাড়িয়ে দেয়। হাতে নিয়েই মুহূর্ত দেরি না করেই মেহেদি টান দেয় আর সঙ্গে সঙ্গে মনে হয় পুরো ফুসফুস বুঝি পুড়ে যাচ্ছে। কাশি দিয়ে ফেলে।
আন্তরিকভাবে সামসা হালকা উঠে দাঁড়ায়। মেহেদির দিকে খানিকটা ঝুঁকে তার পিঠে হাত রাখতে গিয়েও সরিয়ে নেয়। বলে, আপনার বোধহয় অভ্যাস নেই এতে।
একটু ধাতস্থ হয় মেহেদি ততক্ষণে। অভ্যাস? আমার আসলে ঘুম ছাড়া আর কোনও কিছুতেই অভ্যাস নাই।
কেন, এই যে বেঁচে থাকাটা? এটাও কি অভ্যাস নয়?
ভারি কথা বলারও চর্চা নাই আমার। বলে শব্দ করে হেসে ফেলে মেহেদি। একটু থেমে আবার বলে, তবে স্বয়ং কাফকার চরিত্র যখন হাজির এই বিরানভূমিতে, এক আধটু দার্শনিক কথা বলাই যায়।
ট্রেন চালু হবার আওয়াজে দুজনের হাসির শব্দ চাপা পড়ে যায়।
যাক, অবশেষে যাত্রা শুরু হলো।
মেহেদি বলে, যাত্রা শুরু নাকি কেবল? আমি তো ভেবেছিলাম শেষের কাছাকাছি এসে গেছি।
হতে পারে, আবার নাও হতে পারে। যদিও অনিশ্চিত শোনায় সামসার কণ্ঠ। বিড়বিড় করে বলে, এমন আগেও এসেছে অনেকে, কেউ স্থায়ী হয় নি, গার্ডের মতো যেন পাহারা দিচ্ছি গুপ্তখনির মুখ। মৃদুস্বরে বলা কথাটি শুনতে পায় না মেহেদি।
হেলান দিয়ে বসে জানালার দিকে তাকায় সে। সবুজ গাছ-মাঠ-আকাশ দ্রুত সরে যেতে থাকে, তারা যেন আরও গভীর, গাঢ় সবুজে প্রবেশ করতে থাকে। সবুজ গাঢ় হলেও কেমন একটা চাপা বিমর্ষভাব দেখতে পায় মেহেদি। নজর সরিয়ে সে জানতে চায়, আপনি কি আবার পোকা হতে চাচ্ছেন? কিংবা ভাবছেন? কেমন যেন একটা আক্ষেপ টের পাওয়া গেল আপনার কথায়।
প্রশ্নটা শুনে চুপ হয়ে যায় সামসা। প্রশ্নটা সোজা হলেও উত্তর কঠিন তার জন্য। এখন তো কেউ বেঁচে নেই, কাকে সে দেখাবে? পুরো পৃথিবীতে এখন সে বিখ্যাত, কিন্তু সামসা নিশ্চিত জানে, তাকে কেউ বিশ্বাস করবে না, ভাববে গাল-গপ্পো ছাড়ছে। কিন্তু মেহেদি একটিবারের জন্য বিব্রতকর বিষয়টি জানতে চাইছে না; আপনি কি সত্যি গ্রেগর সামসা?- হ্যাঁ, জানতে চাইলে সামসা অবাক হতো না। বরং এই আক্রমনটির জন্য সে প্রস্তুত হয়ে ছিল।
পোকা হয়ে গেলে আমার কী লাভ হবে?
লাভ প্রসঙ্গে মেহেদির মনে হয়, কিছু একটা লাভের আশায়, লোভের খপ্পরে পড়েই সে রওনা দিয়েছিল। লোভের মূল জায়গাটা ধরতে চায়; মিতু আপার সুনজর নাকি দিকশূন্যপুরের নারীদের অদেখা সৌন্দর্য? জীবনে প্রথমবার একটি দায়িত্ব পেয়েছিল যেখানে অর্থপ্রাপ্তির সম্ভাবনা আছে- সেই পয়সার ঝনঝনানির আকর্ষণ কম নয়। কিন্তু গ্রেগর সামসা কেন লাভের কথা ভাববে? সে তো সাধারণ কেউ নয়। হয়তো একসময় ছিল কিন্তু এখন এতদিন পর?
এই কথাটিই বলে ফেলার পর সামসার উত্তর দেবার কিছুই থাকে না, আবার অনেককিছুই থাকে। ট্রেন ছুটে চলছে এখন সবুজ এক গহবরের ভেতর দিয়ে। হাতের চুরুট শেষ হয়ে আরেকটা ধরিয়েছে।
সামসা বলে, সবকিছুতে মানুষের স্টেরিওটাইপ চিন্তাভাবনা বুঝলেন। আপনি কিংবা আমি কেউই এর বাইরে নই। লাভের কথা ভাবব না কেন? পরিবারের কথা ভেবেই তো দিন গুজরান করেছিলাম। তারপর এই যে আবার আমার পুর্নজন্ম হলো মানুষ হিসেবে, আটকে আছি এই ট্রেনে। কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। আমি তো একটা মানুষ, এই মানুষের চেয়ে ঐ কীট বড় হয়ে গেল সবার কাছে? বলতে বলতে ক্ষেপে ওঠে যেন সামসা।
পাল্টা কিছু বলে না মেহেদি। বরং ভাবে, কথাটা সত্যিই তার নিজের ক্ষেত্রেও। এটা ঠিক সে ফ্যামিলির জন্য কিছু করে নি, উলটো ফ্যামিলিই তাকে টেনে যাচ্ছে ।
আবার পিঁপড়ের দল দেখতে পেয়ে চুপ হয়ে যায় মেহেদি। ঠিক, সেই বুড়ো আঙুলের আশেপাশে ঘুরপাক খাচ্ছে। অপর পাশে বসে থাকা সামসার দিকে তাকে তাদের নজর নেই। এই প্রথম, আচমকা মেহেদির মনে হয়, ওরা হয়তো তাকে কিছু বলতে চায়। একটু নিচে ঝুঁকে বসে। সামসা তাকে আটকায় না। সে উঁবু হয়। তখন তাকেও যেন কাফকার সেই পোকাটির মতো দেখায়, গ্রেগর সামসার মতোই দেখায়। অবলোকন করে সামসা বিস্মিত হয় কি হয় না, তার আগেই মেহেদি স্পষ্ট শুনতে পায় পিঁপড়ের কথা।
মেহেদিকে পিঁপড়েদের ভেতর থেকে একজন বলে- মানুষের ভেক ধরে আছিস কেন, বোকার হদ্দ? পিঁপড়ে সমাজের গ্রেগর সামসা হয়ে আর কতদিন? কি এক গল্প লিখেছিল, আমাদের কাফকা। এক সকালে মেহেদি ঘুম থেকে উঠে দেখে সে মানুষ হয়ে গেছে। আর তাতেই সর্বনাশ ঘটে তোর। সত্যি, সত্যি মানুষ হয়ে পৃথিবীর দুনিয়ায় চলে গেলি। ফিরে আয়, ফিরে আয়- যেন কোরাস গেয়ে ওঠে বাকি সবাই।
ধড়মড় করে উঠে বসে মেহেদি। সামসা কৌতূহলী নয়ন মেলে তাকায়। তবে প্রশ্ন না করে মেহেদিকে ধাতস্থ হতে সময় দেয়।
খানিকবাদে মেহেদি বলে, আপনার সঙ্গে আমার জীবনের বেশ বড় পার্থক্য আছে। দেখেন, সেই সকালে আপনার রুপান্তর ঘটার পর, বাসার সব মানুষ কেমন ভয়ে ভয়ে দূরে সরে গেল। অথচ আপনার সেটা প্রাপ্য ছিল না। অথচ আমাদের এখানে সন্তান যত অর্থব হোক না কেন, বাবা-মা কখনো তাদের পরিত্যাগ করে না। বলতে বলতে গলা ধরে আসে মেহেদির। এক ফোট চোখের জল লাফিয়ে পিং পং বলের মতো জানালায় গিয়ে লাগে আর শব্দের সঙ্গে সেখানে ফাটলও সৃষ্টি হয়।
যদিও সামসাকে তার দীর্ঘদিনের পুরোনো বন্ধু বলে মনে হয়, তারপরেও পিঁপড়ের সঙ্গে একতরফা কথোপকথনের বিষয়টি পুরো এড়িয়ে যায় মেহেদি।
সামসা বলে, প্রত্যেকের নিজের একটা ভাবনার জায়গা থাকে। আপনি এখন চাইলেই নিজের অবস্থার পরিবর্তন করতে পারবেন।
ঠোঁট উল্টিয়ে মেহেদি বলে, ইচ্ছা নাই।
হেসে ওঠে সামসা। জানি, কেন এ কথা বলছেন। ভাবছেন, খুব ভালো ভদ্র, সামাজিক জীবন-যাপনের শেষ ফলাফল কী? এখন থেকে ভিন্নকিছু? তা তো নয়। মৃত্যু অবধারিত সত্য।
মৃত্যু যদি সত্য হবে তাহলে আপনি এখানে কিভাবে এলেন? আমি যার সঙ্গে কথা বলছি সে কে? আপনাকে দিয়েই তাহলে বলা যায়, সত্যের গভীরেও আরও সত্য থাকে। তবে সব সত্য গ্রহন করবার মতো আত্মবিশ্বাসী আমি নই।
সামসা বলে, এর আগে আমার কোনও জীবিত মানুষের সঙ্গে দেখা হয় নি। এমনও হতে পারে, আপনিও বেঁচে নেই। এই বাস্তবতা নিতে পারবেন?
এবার সত্যি ভয় পায় মেহেদি আর দেখতে পায় জানালার কাঁচের ফাটল একটু একটু করে বড় হচ্ছে, পিঁপড়ার গুঞ্জন স্পষ্ট হচ্ছে। খুব দ্রুত ব্যাগের চেইন খুলে, যেন সামনে অপেক্ষামান প্রেমিকার সামনে জিপার খুলছে প্রেমিক।
অ্যাসাইনমেন্টের হলুদ খাম একটানে সরসর করে ছিঁড়ে ফেলে। একটি সাদা কাগজে গুটিগুটি অক্ষরে লেখাগুলো পড়তে তার কষ্ট হয়, সে চোখের সামনে নিয়ে এলে অবশেষে পড়তে পারে।
সেখানে লেখা, জনাব মেহেদিকে জীবনভর অজস্র বড় অপরাধ করার সুযোগ থাকার পরেও অল্পতে সন্তুষ্ট থাকায় এবং মিতু আফরিনের শারীরিক আহবানে সাড়া না দেয়ায়, ব্যাভিচারে লিপ্ত না হওয়ার আজীবনের জন্য দিকশূন্যপুরে প্রেরণ করা হলো। দিকশূন্যপুরের নির্জনতায় তাকে জ্বলে-পুড়ে কাটাতে হবে মহাকালের পুর্নজন্ম অবধি।
চমকে ওঠে মেহেদি। পাশে বসে থাকা, গ্রেগরের হাত ধরতে গিয়ে দেখে হাত ধরতে পারছে না।
গ্রেগর সামসা বলে, মৃত মানুষ একে অপরকে স্পর্শ করতে পারে না। কিছুক্ষণ পর আপনাকে নামিয়ে, ট্রেন চলে যাবে। এমন আগেও হয়েছিল। প্রতিবার ভাবি ব্যতিক্রম হবে কিন্তু হয় না। কি এক ভয়াবহ নিঃসঙ্গ সময়!
তার মানে আপনি শুরু থেকেই জানতেন?
সামসা উত্তর না দিয়ে হেঁটে চলে যায় সিট ধরে ধরে বগির শেষপ্রান্তে। মেহেদি একবার ভাবে পিছে পিছে যাবে, তারপর ভাবে সে আসলে কোথায় যাবে? জনমভর সে কোথায় যেতে চেয়েছিল? গ্রেগর সামসা যে তার বন্ধু নয়, এ কথা ভেবে তার খারাপ লাগে। পরক্ষণেই নিজেকে বলে, ঘন্টাখানেকের পরিচয়ে এর চাইতে বেশি কিছু আশা করা অন্যায়। এমনও হতে পারত, সামসা না এলে মরণের স্বাদ বুঝতে তার আরও ক’দিন পার হয়ে যেত।
মুহূর্তের ভেতরেই তাই নিজেকে সম্পূর্ণ একা আবিষ্কার করে মেহেদি। পিঁপড়াগুলোও নেই। অন্ধকার হয়ে আসে চারপাশ। ট্রেনের গতিও ক্রমশ কমতে থাকে।
কাগজটি হাতের ভেতর থেকে মোমের মতন গলে যায়। কাগজ তো মোম নয়। হয়তো মোমই, এতদিন কাগজের অভিনয় করে চলছিল।
মেহেদি চোখের সামনে স্পষ্ট দেখতে পায়, তার বাবা-মা, অন্য একটি ট্রেনে চড়ে কোথাও যাচ্ছে, ঠিক যেমন করে গ্রেগর সামসার ফ্যামিলি ট্রামে চেপে নতুন স্বপ্ন ছুঁতে চেয়েছিল। মিতু আপাকেও দেখতে পায় জিলা স্কুলের পাশের কবরস্থানের সামনে দিয়ে চুপচাপ হেঁটে যাচ্ছেন। এখানেই কি তবে তার শেষ আশ্রয় মিলেছে? মেহেদি বুঝতে পারে, নিজের মৃত্যুর কথা জেনে তার খুব একটা খারাপ লাগছে না। চোখ বন্ধ করবার আগে তার শেষবারের মতো মনে হয়, এবার কি তবে রানী পিঁপড়ের সঙ্গে তার সঙ্গম হবে? মিতু আপা কি রানী পিঁপড়ে?