লেখকঃ মানসুরা হোসাইন
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা কর্মস্থলে যৌন হয়রানির লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না। অথচ যৌন হয়রানি প্রতিরোধে হাইকোর্ট একাধিক নির্দেশনা দিয়েছেন।
২০০৯ সালে এক রায়ে যৌন হয়রানি নিয়ে সংজ্ঞাও নির্ধারণ করে দিয়েছেন হাইকোর্ট। সংজ্ঞা অনুযায়ী, অনাকাঙ্ক্ষিত যৌন আবেদনমূলক আচরণ (সরাসরি বা ইঙ্গিতে), যেমন: শারীরিক স্পর্শ বা এ ধরনের প্রচেষ্টা, প্রাতিষ্ঠানিক ও পেশাগত ক্ষমতা ব্যবহার করে কারও সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করা, যৌন হয়রানি বা নিপীড়নমূলক উক্তি এবং যৌন সুযোগ লাভের জন্য অবৈধ আবেদন যৌন হয়রানির সংজ্ঞার মধ্যে পড়বে।
পর্নোগ্রাফি দেখানো, যৌন আবেদনমূলক মন্তব্য বা ভঙ্গি, অশালীন ভঙ্গি, যৌন নির্যাতনমূলক ভাষা বা মন্তব্যের মাধ্যমে উত্ত্যক্ত করা, কাউকে অনুসরণ করা বা পেছন পেছন যাওয়া এবং যৌন ইঙ্গিতমূলক ভাষা ব্যবহার করে ঠাট্টা বা উপহাস করা হলেও তা এ সংজ্ঞায় পড়বে। এখানেই শেষ নয়, চিঠি, টেলিফোন, মোবাইল, এসএমএস, ছবি, নোটিশ, কার্টুন, বেঞ্চ, চেয়ার, টেবিল, নোটিশ বোর্ড, অফিস, ফ্যাক্টরি, শ্রেণিকক্ষ ও বাথরুমের দেয়ালে যৌন ইঙ্গিতমূলক অপমানজনক কোনো কিছু লেখা, ব্ল্যাকমেল অথবা চরিত্র স্খলনের উদ্দেশ্যে স্থির বা চলমান চিত্র ধারণ করা, যৌন নিপীড়ন বা হয়রানির কারণে খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক, প্রাতিষ্ঠানিক ও শিক্ষাগত কার্যক্রমে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকতে বাধ্য হওয়া, প্রেম নিবেদন করে প্রত্যাখ্যান হয়ে হুমকি দেওয়া বা চাপ প্রয়োগ করা এবং ভয় দেখিয়ে বা মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে বা প্রতারণার মাধ্যমে যৌন সম্পর্ক স্থাপন বা স্থাপনে চেষ্টা করা হলেও তা যৌন হয়রানি হবে।
শুধু সংজ্ঞা নির্ধারণ নয়, ১৯৯৯ সাল থেকে শুরু করে বিভিন্ন সময় হাইকোর্ট নানা নির্দেশনায় যৌন হয়রানি প্রতিরোধে করণীয় নির্ধারণ করে দিয়েছেন। এতে কি দেশে যৌন হয়রানি থেমেছে?
এর উত্তর জীবনের বিনিময়ে দিয়েছেন ফেনীর সোনাগাজী উপজেলার মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি। তাঁর মৃত্যুর পরও কি এ ধরনের ঘটনা থেমে গেছে?
প্রতিদিনের গণমাধ্যমে প্রকাশিত এবং প্রচারিত প্রতিবেদন এর উত্তর দিচ্ছে। প্রথম আলোসহ অন্যান্য জাতীয় দৈনিকে প্রতিদিন ধর্ষণ ছাড়াও হাইকোর্টের সংজ্ঞা মতো যৌন হয়রানির একাধিক খবর থাকছে। তাহলে প্রশ্ন আসতে পারে, নুসরাত মরে গিয়ে কী লাভ হলো? হাইকোর্ট যে এত নির্দেশনা দিলেন, তারই–বা কী হলো?
নুসরাতের অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যাওয়ার ঘটনায় জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের তদন্ত প্রতিবেদন বলছে, স্থানীয় প্রশাসন ও মাদ্রাসার পরিচালনা পরিষদ যথাসময়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিলে নুসরাতের হত্যাকাণ্ড এড়ানো যেত। কমিশন বলেছে, এ ঘটনায় পুলিশের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা অবহেলা ও অপরাধ করেছেন। জেলা প্রশাসনেরও অবহেলা ছিল।
৬ এপ্রিল ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসায় আলিম পরীক্ষা দিতে গেলে কৌশলে নুসরাতকে ছাদে ডেকে নিয়ে গিয়ে গায়ে আগুন ধরিয়ে দেন মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলার অনুগত কয়েকজন শিক্ষার্থী। গত ২৭ মার্চ এই অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগে মামলা করেন নুসরাতের মা। মামলা প্রত্যাহারে রাজি না হওয়ায় নুসরাতের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। শরীরে ৭৫ শতাংশের বেশি পোড়া নিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে ১০ এপ্রিল হার মানেন নুসরাত।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের তদন্ত প্রতিবেদনের কথাগুলো তো নতুন কোনো কথা নয়। এ ধরনের কথাগুলোই হাইকোর্ট বিভিন্ন সময় বিভিন্ন নির্দেশনায় বলেছেন।
২০০৯ সালের ১৪ মে হাইকোর্ট কর্মক্ষেত্র, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি–বেসরকারিসহ সব ধরনের প্রতিষ্ঠানে নারীর প্রতি যৌন হয়রানি প্রতিরোধের জন্য এক রায়ে বেশ কিছু নির্দেশনা দেন। যৌন হয়রানি প্রতিরোধে জাতীয় সংসদে আইন তৈরি না হওয়া পর্যন্ত এই রায়ই আইন হিসেবে কাজ করবে এবং সংবিধানের ১১১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী হাইকোর্টের দেওয়া দিকনির্দেশনামূলক রায়টি পালন করা বাধ্যতামূলক। হাইকোর্টের ওই রায়ে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মস্থলে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে অভিযোগকেন্দ্র এবং তা পরিচালনার জন্য ন্যূনতম পাঁচ সদস্যের কমিটি থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।
মানবাধিকার কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়, সিরাজ উদদৌলা ২০০১ সাল থেকে সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসায় অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করে আসছেন। তাঁর কক্ষে একই সময় একজনের বেশি ছাত্রীর প্রবেশ নিষেধ ছিল। সিরাজ উদদৌলার বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় ছাত্রী ও অভিভাবকেরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, মাদ্রাসার গভর্নিং বডি ও থানায় অভিযোগ করেন। কিন্তু স্থানীয় প্রশাসন ও মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। অর্থাৎ হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী এ মাদ্রাসায় কোনো কমিটির অস্তিত্বই ছিল না।
খ্রিষ্টীয় নববর্ষ উদ্যাপন করতে গিয়ে ১৯৯৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর রাতে এক তরুণী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় যৌন নিপীড়নের শিকার হন। গণমাধ্যমে ওই তরুণীর ছবিসহ প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে আলোচনার ঝড় ওঠে। এ ঘটনায় বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতি (বিএনডব্লিউএলএ) ২০০০ সালের ১৮ জানুয়ারি জনস্বার্থমূলক একটি রিট করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট ২০০৬ সালের ২৩ মে ঢাকা সিটি, বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় কোনো নারী যাতে যৌন হয়রানির শিকার না হন, অসামাজিক কাজ যাতে না ঘটে, সে জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও সরকারকে বিভিন্ন নির্দেশনা দেন।
এ নির্দেশনা বাস্তবায়িত হয়নি, তার প্রমাণ মেলে ২০১৫ সালে। বছরটির বাংলা নববর্ষের দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ফটকে যৌন হয়রানির শিকার হন কয়েকজন নারী। ২০১৫ সালে নববর্ষে যৌন নিপীড়নের ঘটনায় ১৬ এপ্রিল হাইকোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে আবার রুল দেন। ঘটনার চার বছর পরের অবস্থা হচ্ছে—জড়িত ব্যক্তিদের পুলিশ চার বছরেও খুঁজে পায়নি।
২০১৫ সালেই বিএনডব্লিউএলএর সাবেক নির্বাহী পরিচালক সালমা আলী তাঁর নেতৃত্বে তিনজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিকের সঙ্গে দেখা করে যৌন হয়রানিমুক্ত শিক্ষা ও কর্মপরিবেশ তৈরিতে হাইকোর্টের নীতিমালার বাস্তবায়ন প্রসঙ্গে যে চিঠি দেন, তাতে উল্লেখ করা হয়েছিল, বিভিন্ন সময়ে হাইকোর্ট নির্দেশ দিলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি।
এর আগে ২০১০ সালে বিএনডব্লিউএলএ আরও একটি রিট করে। পরে ২০১১ সালের ২৫ জানুয়ারি হাইকোর্ট যে নির্দেশনা দেন, তাতে প্রতিটি থানায় যৌন হয়রানিসংক্রান্ত অভিযোগ গ্রহণের জন্য পৃথক সেল গঠন এবং স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য স্থান, যেখানে নারীদের অংশগ্রহণ থাকে, সেখানে বিশেষ গুরুত্ব দিতে বলা হয়।
নুসরাতের ঘটনায় থানা-পুলিশের ভূমিকা কী ছিল, তা মানবাধিকার কমিশনের প্রতিবেদনেই স্পষ্ট হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়ার পর থানা-পুলিশ নুসরাতকে বিভিন্ন অশালীন প্রশ্ন করে। তারা বিষয়টিতে হালকাভাবে দেখানোর চেষ্টা করে। পুলিশের সঙ্গে সাক্ষাতের ভিডিও বিভিন্ন সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়। তবে নুসরাতের মৃত্যুর পর বিভিন্ন চাপের মুখে এ ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের গ্রেপ্তারে তৎপরতা লক্ষ করা যায়।
হাইকোর্টের নির্দেশনা বাস্তবায়নে বিভিন্ন গবেষণার ফলাফলও সন্তোষজনক নয়। গত বছর অ্যাকশনএইড বাংলাদেশের গবেষণা বলছে, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের ৮৭ শতাংশই যৌন হয়রানি প্রতিরোধে হাইকোর্টের দিকনির্দেশনার কথা জানেন না। কর্মক্ষেত্রে এই হার ৬৪ দশমিক ৫ শতাংশ। মূলত, নির্দেশনার বিষয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্র কর্তৃপক্ষের অসচেতনতা ও না মানার ঝোঁকের কারণে এই অবস্থা।
গত বছরের মে মাসে রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট) আয়োজিত ‘বিচারব্যবস্থায় নারীর অংশগ্রহণ: প্রতিবন্ধকতা ও সম্ভাবনা’ শীর্ষক জাতীয় সম্মেলনে ব্লাস্টের ২০১৭ সালের এক গবেষণার ফলাফল উল্লেখ করে জানানো হয়, দেশের কোনো আদালতেই হাইকোর্টের গাইডলাইন অনুযায়ী যৌন হয়রানি প্রতিরোধে অভিযোগ কমিটি গঠন করা হয়নি। ফলে, নারী বিচারক, আইনজীবী ও বিচার-সংশ্লিষ্ট অন্য নারীরা নিজে যখন যৌন হয়রানির শিকার হন, তখন প্রতিকার পান না। যথাযথ কর্তৃপক্ষ না থাকায় যৌন হয়রানির শিকার বেশির ভাগ নারী বিষয়টি চেপে যান।
বর্তমানে বাংলাদেশেও ‘হ্যাশট্যাগ মি টু’ আন্দোলনের অংশ হিসেবে এ পর্যন্ত নয়জন নারী নিজেদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া যৌন হয়রানির ঘটনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ করেছেন। যৌন হয়রানির ঘটনায় মুখ খোলা যাবে না—তাতে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে।
কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে প্রশাসন অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হচ্ছে। যেমন চলতি মাসেই গোপালগঞ্জে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্রীকে যৌন হয়রানির অভিযোগে অভিযুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই) বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ও সহকারী অধ্যাপক মো. আক্কাস আলীকে চাকরিচ্যুতিসহ পাঁচ দফা দাবিতে ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। তদন্তে যৌন হয়রানির অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় এই শিক্ষককে বিভাগীয় প্রধানের পদ থেকে আজীবনের জন্য অব্যাহতি এবং আগামী চার বছর তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ধরনের প্রশাসনিক ও একাডেমিক কাজ থেকে বিরত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শৃঙ্খলা কমিটির সদস্যরা। এ বিশ্ববিদ্যালয়েও হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী যৌন হয়রানি প্রতিরোধে কোনো কমিটি নেই। অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে এ ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে—তার নজিরও খুব একটা নেই।
সম্প্রতি যৌন হয়রানি প্রতিরোধে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের আওতাধীন সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জরুরি ভিত্তিতে পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছে অধিদপ্তর। এই ধরনের নির্দেশ আগেও দেওয়া হয়েছিল। ফেনীর নুসরাতের ঘটনায় আবার এ কমিটি গঠনের নির্দেশ দেওয়ার কথা জানিয়েছেন অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা।
এখন প্রশ্ন আসতেই পারে, এভাবে কত নুসরাতকে মরতে হবে? যৌন হয়রানির ঘটনায় হাইকোর্ট আর কত নির্দেশনা দেবেন?