গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন

ছেলেবেলার ভূগোল বইয়ের পৃষ্ঠায় লেখা এবং বাবার মুখে শোনা “গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন” সবসময় আমাকে আকৃষ্ট করত।স্বচক্ষে গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন দেখতে পাব তা কখন কল্পনা করতে পারি নি।তাই যখন জানতে পেরেছিলাম গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের “লেবার ডে” র ছুটিতে অ্যারিজোনা প্রদেশের গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন যাওয়া হচ্ছে তখন অনাবিল আনন্দে মনটা ভরে গেল।স্বামীর কর্মসূত্রে আমার বর্তমান ঠিকানা টেক্সাসের আরভিং শহর।সেখানকার ডালাস ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট থেকে আড়াই ঘণ্টা বিমান যাত্রা করে পৌঁছলাম সারা বিশ্বের মনোরঞ্জনের রাজধানী  “লাস ভেগাস”-এর ম্যাকক্যারেন ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে।বিমান থেকে রাতের ভেগাসকে স্বপ্নের শহরের মত মনে হচ্ছিল। কয়েকঘন্টা সেই স্বপ্নপুরীতে কাটিয়ে রাত বারোটা নাগাদ রওনা হলাম বহু প্রতীক্ষিত গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের উদ্দ্যেশে।

লাস ভেগাস শহরটি মহাভী মরুভূমির উপর অবস্থিত। রাতের ঘন অন্ধকার ভেদ করে আমাদের গাড়ি মরুভূমির উপর দিয়ে ছুটে চলেছে। নিস্তব্ধ পথের দু-ধারে শুধু বালির পাহাড়। পাঁচ ঘণ্টা গাড়ি সফর শেষ করে আমরাযখন গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন  ন্যাশনাল পার্কের সাউথ রিমে প্রবেশ করছি তখন পূর্ব দিগন্ত সূর্যের রক্তিম আভায় আলোকিত।ভোরের সেই মনোরম পরিবেশ উপভোগ করতে করতে আমরা এখানকার মাস্বিক লজে পৌঁছলাম।ঘড়ির কাঁটা তখন আঁটটা ছুঁই ছুঁই করছে। র‍্যাসবেরি মাফিন আর স্ক্রাম্বেল্ড এগ সহযোগে প্রাতরাশ সেরে ম্যাপ দেখে সকলে মিলে তৈরী করে নিলাম আমাদের ট্যুর প্ল্যান।কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর চেপে বসলাম শাটল বাসে।এখানকার বাস পরিষেবা অনবদ্য।হারমিট  রেস্ট রুটের বাসে করে নিখরচায় একে একে ঘুরে নিলাম পিমা পয়েন্ট,মহাভী পয়েন্ট,হপি সহ আরো অনেক পয়েন্ট।আঁকাবাঁকা পথের একদিকে সবুজের সমারোহ আর অন্যদিকে  বিরাজমান দিগন্ত বিস্তৃত ক্যানিয়ন। প্রকৃতির সৃষ্টি দেখতে কখন যে অন্য জগতে চলে গিয়েছিলাম বুঝতেই পারিনি।

গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন ২৭৭ মাইল দীর্ঘ, প্রস্থ ১৮ মাইল, এবং এর গভীরতা ৬,০৯৩ ফিট। ক্যানিয়নের মধ্য দিয়ে বয়ে চলেছে কলোরাডো নদী।একটি নদী এমন প্রকাণ্ড ক্যানিয়ন গড়ে তুলতে পারে তা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। সূর্যের আলো আর মেঘের ছায়া ক্যানিয়নের  রূপকে কয়েকগুণ বাড়িয়ে তুলেছিল।এক দৃষ্টিতে দেখছিলাম ভূগোল বইয়ের গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের সেই মোহময়ী রূপ।ঘোর কাটল আমার কর্তার ডাকে।এমন নৈসর্গিক দৃশ্য দেখানোর জন্য মন থেকে তাঁকে জানালাম অসংখ্য ধন্যবাদ। কিছুক্ষণ বাদে হাত ঘড়ির দিকে নজর দিতেই বুঝতে পারলাম মধ্যাহ্ণভোজের সময় হয়ে এসেছে। অতএব এখন অপেক্ষা বাসের। প্রতি পনেরো মিনিট অন্তর বাস চলাচল করে এই রুটে। কিছুক্ষণের মধ্যে পৌঁছে গেলাম লজে। সেখানে মধ্যাহ্ণভোজ সেরে গাড়ি পাড়ি দিল  পরবর্তী গন্তব্যের ঠিকানায়।

Gallery:

পড়ন্ত বিকেলে আমাদের গাড়ি ছুটে চলেছে ডেসার্ট ভিউ ওয়াচটাওয়ারের দিকে।এই ওয়াচটাওয়ারটি “ইন্ডিয়ান ওয়াচটাওয়ার” নামে পরিচিত। ১৯৩০ সালে বিখ্যাত স্থপতি ম্যারি কলটার এটির নকশা তৈরী করেন এবং ১৯৩২ সালে ওয়াচটাওয়ারটির কাজ সম্পূর্ণ হয়।৭০ ফুট লম্বা এই স্থাপত্যটি গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের সাউথ রিমের পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত।একটি ষ্টীলের ফ্রেমের উপর পাথর বসিয়ে স্থাপিত হয়েছে এই  ওয়াচটাওয়ারটি। এর ভেতরের ছোট ছোট জানালা দিয়ে ক্যানিয়নের নানান দিকের দৃশ্য দেখা যায়।ওয়াচটাওয়ারের প্রথম তলে হোপী শিল্পী ফ্রেড ক্যাবটি তুলে ধরেছেন হোপী পৌরাণিক কাহিনীর নানান চিত্র। এখানকার খাঁড়া সিঁড়ি বেয়ে পৌঁছে গেলাম ওয়াচটাওয়ারের ছাদে। সেখান থেকে যতদূর চোখ যায় শুধু ক্যানিয়ন।

সূর্য তখন পশ্চিম আকাশে। বাইরে প্রবল ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে। শীতের পোশাক বলতে কিছুই ছিল না আমাদের কাছে। ঠাণ্ডায় প্রায় জমে যাওয়ার উপক্রম। সব কিছু উপেক্ষা করে আমরা দাঁড়িয়ে আছি সূর্যাস্তের আশায়। ডেসার্ট ভিউ ওয়াচটাওয়ার থেকে সূর্যাস্ত খুব সুন্দর দেখা যায়।এ সময় ক্যানিয়ন যেন আরো রূপবতী হয়ে ওঠে।অপেক্ষার অবসান হল যখন অপলক দৃষ্টিতে দেখছিলাম সূর্যাস্তের সময়ের অপরূপ ক্যানিয়নকে। একটা ক্যানিয়নের যে কত রূপ তা বোধহয় এখানেই দেখা যায়। বিশ্বের নানান দেশের থেকে লোক এখানে আসে সূর্যাস্ত দেখতে।আমার সাথে পরিচয় হল অনেকের। তাঁদের মধ্যে একটি বাঙালি পরিবার ও ছিল।সকলেই এই মনোরম দৃশ্য ক্যামেরা বন্দী করতে ব্যস্ত। ধীরে ধীরে সূর্য্যি মামা পাহাড়ের কোলে ঢলে পড়ছে আর ঠাণ্ডার প্রকোপ ক্রমে বেড়েই চলেছে। কিন্তু আমি তখন ও চোখ সরাতে পারিনি।

কিছুক্ষনের মধ্যে সন্ধ্যে নেমে পড়েছিল। এক দৌড়ে প্রবেশ করি গাড়ির ভেতরে। চটপট হীটার চালিয়ে শরীর গরম করে নিলাম। এবার ফেরার পালা। গাড়ী রওনা হল লজের দিকে। পাহাড়ি রাস্তা ধরে আমাদের গাড়ি এগিয়ে চলেছে। সারাদিনের স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে পৌঁছলাম লজে।রাতটা সেখানে কাটিয়ে পরদিন ভোরে গ্র্যান্ড ক্যানিয়নকে বিদায় জানালাম। যেতে মন চাইছিল না। মনে হচ্ছিল আর একটা দিন থেকে গেলে হত না? কিন্তু ফিরতেই হল। ফেরার সময় নিয়ে আসলাম একরাশ মধুর স্মৃতি। তাইতো বারবার বলতে ইচ্ছে হচ্ছে “আহা কি দেখিলাম, জন্ম জন্মাতরেও ভুলিব না।”

By তনয়া সরকার

Comments (0)
Add Comment