আমাজনের জলে-জঙ্গলে

দিনের বেলাতেও ছায়া ছায়া আঁধার। পায়ের নীচে ঘন গুল্মের চাদর। আকাশছোঁয়া প্রাচীন গাছগুলো একে অপরকে জড়িয়ে ধরেছে নিবিড়তায়। পথ বলতে কিছু নেই। গাইড ভদ্রলোক যেভাবে নিয়ে চলেছেন, আমরাও চলেছি জঙ্গল ঠেলতে ঠেলতে। দুহাতে গাছপালা সরিয়ে তৈরি করে নিচ্ছি পথ। অদ্ভুত একটা রোমাঞ্চ লাগছে। আমাজনের জঙ্গল…! সত্যি স্বপ্নপূরণ হল তাহলে এতদিনে!
২রা জুলাই ব্রাজিলের সাও পাওলো থেকে মানসে এসে পৌঁছালাম, তখনও জানিনা ঠিক কোথায় থাকা হবে। আগাম কোন হোটেল বুক করাও ছিল না। আমাদের পাঁচজনের ছোট্ট দল। দলনেতা জুরান সাহা বাদে আমরা সকলেই মহিলা। এয়ারপোর্টে আমাদের বসে থাকতে বলে জুরান খোঁজখবর করে জঙ্গলের মধ্যে থাকা যাবে এমন একটা গেস্টহাউস বুক করে ফেললেন।
এয়ারপোর্টেই এজেন্টের মারফত কথাবার্তা হয়ে যাওয়ার পর গাইড সমেত গেস্ট হাউসের গাড়ি আমাদের নিতে এল। ড্রাইভার সহ ৬ জনের বসার জায়গা। গাড়ির পেছনটা লরির মতো খোলা, ওখানে সব মালপত্র তোলা হল। গাড়ি চলেছে আর গাইড ধারাভাষ্য দিচ্ছেন – মানসে ১৮ লক্ষ লোকের বসবাস। আমাজনের জঙ্গলের বেশিরভাগটাই রয়েছে এই মানস রাজ্যেই। আমাজনের দুটো অংশ আপার আমাজন, লোয়ার আমাজন। এখানে সামসুং, ইয়াহামা ইত্যাদি অনেক বড় বড় কোম্পানির ফ্যাকট্রি আছে। ব্রাজিলের প্রথম ইউনির্ভাসিটি ১৮১৫ খৃষ্টাব্দে মানসেই স্থাপিত হয়। সলোমন এবং নিগ্রো এই দুটো নদী মিলে আমাজন নদীর সৃষ্টি। নিগ্রো নদীর তীরে এসে গাড়িটা দাঁড়াল -বার্জে করে গাড়ি সমেত ওপাড়ে যেতে হবে। একটুক্ষণ অপেক্ষা, তারপর গাড়ি থেকে নেমে বার্জে উঠলাম। গাড়িটাও আলাদা উঠল। বার্জটা চলতে লাগল – কী বিশাল নদী – বাংলাদেশের পদ্মা নদীকে মনে করিয়ে দিচ্ছিল। এই নদীগুলোর উৎপত্তি পেরুর বরফগলা জল থেকে। অন্যপাড়ে পৌঁছে আবার গাড়িতে উঠে পড়লাম। প্রথমে বেশ বড় বড় বর্দ্ধিষ্ণু গ্রাম – আস্তে আস্তে ছোট গ্রাম – এইভাবে অনেকটা চলার পর গাড়ি এসে থামলো জলের ধারে – অল্প অল্প অন্ধকার হয়ে এসেছে। এখান থেকে নৌকো করে আমরা যাবো অতিথিশালায়। সরু লম্বা ধরনের নৌকো – বেশ ভয়ে ভয়েই উঠলাম – মালপত্রগুলো নৌকার মাঝিরা বয়ে এনে তুললো। জলের মধ্যে দিয়ে চলেছি – অজানা পথে – থাকার জায়গায় পৌঁছাতেই যে এমন একটা অভিজ্ঞতা হবে ভাবতেও পারিনি – দারুণ একটা অনুভূতি হচ্ছিল। বেশ খানিকটা চলার পর তরী ঘাটে ভিড়লো। অতিথিশালার নাম পাউসাদা আমাজনিয়া – পাউসাদা অর্থ গেস্ট হাউস। সিঁড়ি দিয়ে বেশ খানিকটা উঠতে হয়। ঢুকেই ডাইনিং কাম রিশেপশন। সবাইকে ফলের রস দিয়ে স্বাগত জানালো। এরপর আমরা আমাদের নির্দিষ্ট ঘরে এলাম। পাহাড়ি পথের ঢালে পাথর বাঁধানো রাস্তা বেয়ে ধাপে ধাপে নামতে হয়। যাওয়া আসার এই পথ খুব সুন্দর। ঘরের ব্যবস্থাও বেশ ভালো, তবে মশার উপদ্রব, গরমও খুব। অবশ্য পাখা ছাড়াও এয়ার কন্ডিশনের ব্যবস্থা আছে। মোটামুটি গুছিয়ে নিয়ে ফিরে এলাম ডাইনিং হলে। রাতের খাবার খেয়ে একটু গল্প করে, আবার ফিরে এলাম ঘরে। এইটুকু আসতে আসতেই নানারকম পাখির ডাক শুনতে পেলাম।
৩রা জুলাই সকালে তাড়াতাড়ি ব্রেকফাস্ট সেরে নিলাম – এবেলা আমরা যাব আমাজনের আপার পার্টে। ট্রেকিং করতে। আবার সেই নৌকো করেই চললাম জঙ্গলের উদ্দেশ্যে। খানিকটা চলার পর নৌকো থামলো – এবার হাঁটা শুরু। নৌকো থেকে নেমে ওপরে উঠতে বেশ অসুবিধা হচ্ছিল। এত ঢালু যে পা পিছলে যাবার জোগাড়। আমাদের গাইড এবং নৌকাচালক দুজনের ওপর ভর দিয়ে উঠে পড়লাম। জঙ্গলের পথে আমরা প্রায় আড়াই ঘন্টা হেঁটেছি। কী অসাধারণ সেই অভিজ্ঞতা। বড় বড় গাছ পড়ে আছে সেগুলো ডিঙিয়ে কখনওবা ঝরা পাতার ওপর দিয়ে মসমস শব্দ করতে করতে আবার কোথাও গাছ এমনভাবে হেলে আছে মাথা নীচু করে চলতে হচ্ছে। অসমান পথ টাল সামলাতে গিয়ে কখনও এমন গাছ ধরে ফেলেছি যে হাতে কাঁটা লেগে গেছে। গাইড বারবার সাবধান করে দিচ্ছেন কাঁটা গাছ সম্বন্ধে। তবুও বেশি পথটা গাছ ধরে ধরেই এগিয়েছি – কখনও কখনও নিজেরাই পরস্পরকে সাহায্য করছি এগিয়ে চলতে। মাঝে মাঝে দেখি গাইড মাটির ওপর সুপারির খোলার মত পাতা উল্টে কী সব খুজে বেড়াচ্ছেন। একটা পাতার নীচ থেকে বেরোল একটা কালো মাকড়সা (টেরান্টুলা)। বিভিন্ন গাছ দেখিয়ে বোঝাচ্ছিলেন কোনটা কী ধরণের গাছ। একটা জায়গা দিয়ে হাঁটতে গিয়ে সবাইকে পিঁপড়ে ছেঁকে ধরলো। কামড়ের সে কী জ্বালা – কম বেশি সবারই জামা কাপড়ের মধ্যে ঢুকে পড়েছিল পিপীলিকা বাহিনী। কামড়ানোর জ্বালা অনেকক্ষণ রইলো। তারপর আবার গাইড ভদ্রলোক একসময় পিঁপড়ের সারির ওপর হাত দিয়ে আমাদের শোঁকালেন – ভারী সুন্দর গন্ধ, ঠিক যেন কোন পারফিউমের। একটা গাছকে দেখিয়ে বললেন এটা হল ম্যাজিক ট্রি। আমরা তো কৌতুহলী হয়ে উঠলাম ব্যাপারটা কী? গাছের একটা ডাল কেটে খুব জোরে ঝাঁকালেন। আর কী আশ্চর্য ঐ ডালটার দুপাশ থেকে লম্বা লম্বা খেজুর পাতার মত পাতা বেরিয়ে এল। এই পাতা জঙ্গলের অধিবাসীরা ঘরের চাল হিসাবে ব্যবহার করেন। ঘন জঙ্গলে ঘুরে আমরা অনেককিছু দেখলাম, শিখলাম, জানলাম – সত্যিকারের অনেক অভিজ্ঞতা হল।

বিকেলবেলা জঙ্গলের লোয়ার পার্ট-এ ঘোরা। অর্থাৎ অ্যারিউ নদীতে নৌকা ভ্রমণ। কথায় বলে জলে-জঙ্গলে – সত্যিসত্যি জলের মাঝেই বিস্তীর্ণ জঙ্গল – ভাবা যায় না। জলের ওপরে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে বিশাল বিশাল গাছ – শিকড় বা কান্ডের অর্দ্ধেকটা রয়েছে মাটির নীচে অথবা জলের তলায়। নৌকো করে যেতে যেতে দেখছি কত রংবেরঙের পাখি সব ঘরে ফিরছে। ছোট্ট ছোট্ট ব্রাজিলিয়ান বাঁদর, দেখলেই ভারী মজা লাগে। জলের মধ্যে আর এক আজব জীব – কুমীরের মত দেখতে কিন্তু আরও একটু ছোট – নাম কাইমন। সেই জন্তুটাকে জলের মধ্যে চেপে ধরে আমাদের গাইড নৌকায় তুললেন। একটু বেসামাল হলেই ঝাপটা মারবে। আমাদের মধ্যে দু’জন একে একে কায়দা করে ধরে কাইমনের সঙ্গে দিব্যি ছবি তুলে নিলেন। তারপর আবার ওটাকে জলে ছেড়ে দেওয়া হল। আস্তে আস্তে সূর্য ডুবে গেলো। মেঘ থাকার জন্য খুব ভালো করে সানসেট দেখা গেল না। শুধু মেঘের চারপাশে লালের আভা। অন্ধকার হয়ে আসছে – এরই মধ্যে চলছে পশুপাখী খোঁজা। গাছের ওপর পেঁচা বসে আছে। অন্ধকারে তার চোখ জ্বলছে। দুটো খুব বড় স্কারলেট ম্যাকাও একসঙ্গে বসে আছে। গাইড বললেন, এই পাখিগুলো সবসময় জোড়ায় জোড়ায় থাকে। একটা মরে গেলে আর একটা আত্মহত্যা করে। অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, পাখি আবার কীভাবে আত্মহত্যা করে? গাইড বললেন, সুদূর আকাশে উড়ে গিয়ে ডানা বন্ধ করে দেয় আর মাটিতে পড়ে মরে যায়। মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে গেল। সত্যি ভাবা যায় না, জীবজগতে এত ভালবাসা! এমন করে আমরাও বোধহয় ভালোবাসতে পারিনা। বিকেল ৪টে থেকে ৮টা পর্যন্ত জলে-জঙ্গলে ঘোরা হল। তাও আবার নৌকো করে। কী রোমাঞ্চকর অনুভূতি। অদ্ভুত এক ভালোলাগার রেশ সারা মন জুড়ে।
৪ঠা জুলাই ভোর ৫ টায় গাইড আমাদের নিয়ে চললেন আমাজনে সূর্যোদয় দেখতে। ছোট ছোট নদী পেরিয়ে একঘন্টা নৌকায় চলার পর গিয়ে পড়লাম ব্ল্যাক রিভার-এ। এখানেই অপেক্ষা সূর্য ওঠার। সারা আকাশে রংবেরঙের আবির ছড়িয়ে পড়ছে। অপলকে চেয়ে আছি রবির প্রতীক্ষায়। আস্তে আস্তে জলের মধ্যে দিয়ে তার আগমন, অর্দ্ধেকটা জলের ভিতর বাকীটা আকাশের গায়ে। কী অপরূপ দৃশ্য। কবির ভাষায় বলতে ইচ্ছে করে না জানি কেন রে এতদিন পরে জাগিয়া উঠিল প্রাণ। ফেরার পথে সকালের আলোতে ডলফিনের লুকোচুরি খেলা -আর এক অভিজ্ঞতা। আস্তানায় ফিরে ব্রেকফাস্ট করে আবার বেরিয়ে পড়লাম জলে। জঙ্গল দেখা কী শেষ হয়! চলতে চলতে মোটা একটা গাছের সামনে নৌকো দাঁড়ালো। ২০০ বছরের পুরনো গাছ। নামSamauma (Mother of the Amazan)। ২৫ জন লোক হাতে হাত মিলিয়ে তবে ধরতে পারবে পুরো গাছটাকে, বাপরে! যেতে যেতে দেখলাম জলের উপর একটা তিনতলা বাড়ি। ১৮৮৯ থেকে ১৮৯১ তে ইংরেজরা তৈরি করেছিল। এখানে এসে থাকতো রবার নেওয়ার জন্য। এইভাবে আরও কিছুক্ষণ জলে-জঙ্গলে ঘুরে ফিরে এলাম অতিথিশালায়। লাঞ্চ করে একটু বিশ্রাম। বিকেলে আবার বেরনো হল মাছ ধরতে। ঘন জঙ্গলে গাছগুলো জলের ওপর এমনভাবে রয়েছে আমাদের নৌকার ওপর প্রায় শুয়ে পড়তে হচ্ছে। মাছ ধরার নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছে সবাই ছিপ ফেলে বসে গেলাম। গাইড এবং নৌকাচালক ছিপে চার লাগিয়ে দিচ্ছিলেন। সবাই-ই একটা দুটো করে মাছ ধরে ফেললাম। চাঁদা মাছের মত দেখতে। মাছ হাতে নিয়ে ফ্যাবল (আমাদের গাইড) অনেক কিছু বোঝালেন। তারপর আবার মাছগুলোকে জলে ছেড়ে দিলেন। মাছ ধরা শেষ করে আমরা চললাম আদিবাসী গ্রাম দেখতে। একটা বাড়িতে ঢুকে দেখলাম ফ্রিজ টিভি সবই আছে। এদের জীবনধারণের প্রধান উপজীব্য হল মাছধরা আর চাষবাস। তবে এই গ্রামটা তুলনামূলকভাবে একটু এগিয়ে আছে। কাল যাব পুরোপুরি আদিবাসী গ্রাম দেখতে। মানসের এক প্রত্যন্ত গ্রামে প্রাকৃতিক গ্যাস পাওয়া গেছে। তাই সব দ্বীপেই আলোর সুন্দর ব্যবস্থা রয়েছে।
৫ই সকালবেলা চললাম আদিবাসী গ্রাম দেখতে। ১৪টা পরিবার -জনসংখ্যা ৪৮। একজন মহিলা এখানে প্রধান। ইনি একদিকে চিকিৎসক একদিকে শিক্ষিকা। এঁর কথাই গ্রামের সবাই মেনে চলেন। মহিলা নিজে নানা রকম ওষুধ তৈরি করেন। ঘরে নানারকম শিকড়বাকড়, হাড়গোড় রয়েছে। সর্বক্ষণ উনুন জ্বলছে। শহরের মানুষও এখান থেকে ওষুধ নিয়ে যান। এখানকার ছেলেমেয়েরা আমাদের নাচগান করে দেখাল। সঙ্গীত এদের রক্তে – কতটুকু বাচ্চা সেও ড্রাম বাজাচ্ছে। এখানে অনেকরকমের বাদ্যযন্ত্র দেখলাম। পড়াশোনা করার জন্য আলাদা জায়গা। সবাই লেখাপড়া করে। গ্রামের প্রধান মহিলাই এদের পড়াশোনা করান। গ্রাম দেখা শেষ করে ফিরে এলাম গেস্ট হাউসে। লাঞ্চ করে মালপত্র নিয়ে দুপুর একটা নাগাদ বেরিয়ে পড়লাম। দুটোয় আবার ঘাটে পৌঁছে ফেরী পার হয়ে চললাম আমাজনের সঙ্গম দেখতে। মাছ বেচাকেনার ঘাটে এসে আমাদের গাড়ি দাঁড়ালো। ঘাটে নামার সিঁড়ি একদম ভাঙাচোরা। এখান থেকে স্পীড বোটে করে চললাম সঙ্গমস্থলে। খুব জোরে জল কাটতে কাটতে ভেসে চলেছি নদীবক্ষে। নদী নয়তো মনে হচ্ছে সমুদ্র। অনেকটা আসার পর অবাক হয়ে গেলাম জলের রঙ দেখে – একদিকে কালো জল – আর একদিকে ঘোলা হলুদ জল পাশাপাশি বয়ে চলেছে। কেউ কারো সঙ্গে মিশে যাচ্ছে না। দুটো জলের তাপের তারতম্যও হাত দিয়ে বেশ বোঝা গেল, একটা খুব বেশি ঠান্ডা আর একটা একটু উষ্ণ। গাইড বললেন, আমাজন পর্বতের বরফগলা জলে উৎপন্ন হয়ে অনেক পথ পেরিয়ে অনেক মাটি খনিজ পদার্থ নিয়ে চলে আসছে তাই এই জল ঘোলা আর ভারি। অন্যদিকে ব্ল্যাক রিভার সমতলেই বৃষ্টির জলে সৃষ্ট – তাই হালকা আর অপেক্ষাকৃত গরম।
অনেককিছু দেখলাম – হয়তো না দেখাই রইল বেশিটা – তবু এবার ফেরার পালা – দূর অরণ্য থেকে চেনা শহরের দিকে। শুধু চোখ বুজলেই নিবিড় সবুজ অরণ্যের আদিম গন্ধ -চেনা দুনিয়াটাকে অচেনা লাগে। হয়তোবা অচেনা পৃথিবীটাই একটু একটু করে রক্তে-ঘ্রাণে আপন হয়ে ওঠে। অপেক্ষা করে থাকি আবার কবে বেরিয়ে পড়ব সেই অচেনার ডাকে।

 তথ্য- মঞ্জুশ্রী সিকদার

Comments (0)
Add Comment