TANGAIL TIMES | টাঙ্গাইল টাইমস

বাঁচানো গেলো না নুসরাতকে

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ফেনীর সোনাগাজীর সেই মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি মারা গেছেন। বুধবার (১০ এপ্রিল) রাত সাড়ে ৯টার দিকে তিনি ঢামেকে মারা যান। ঢামেকের বার্ন ইউনিটের সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
অধ্যাপক রায়হানা আউয়াল বলেন, ‘নুসরাত রাত সাড়ে ৯টায় মারা গেছেন।’

নুসরাতের মৃত্যুর খবরে স্বজনদের আহাজারি
নুসরাতের মৃত্যুর খবরে স্বজনদের আহাজারি

নুসরাত জাহান রাফির চিকিৎসায় গঠিত মেডিক্যাল বোর্ডের প্রধান ও শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের প্রকল্প পরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বুধবার সকাল থেকে তার অবস্থা অবনতি হতে থাকে। একাধিকবার তার হার্ট অ্যাটাক করেছিল, তারপরও সে সার্ভাইভ করেছিল। কিন্তু, রাত সাড়ে ৯ টার দিকে মারা যায়।’
তিনি বলেন, ‘নিহতের পরিবারকে বিষয়টি জানানো হয়েছে। আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা আমরা করেছি।’

নুসরাতের চাচাতো ভাই ওমর ফারুক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘দুপুরে রক্তের দরকার পড়েছিল, তখন আমরা রক্ত সংগ্রহ করে দিয়েছিলাম। কিন্তু, চিকিৎসকরা সকাল থেকে বারবার আমাদের নুসরাতের অবস্থার অবনতির কথা বলছিলেন। চিকিৎসকদের আশঙ্কাই সত্যি হলো।’

মৃত্যুর খবর শুনে বার্ন ইউনিটের আইসিইউ’র সামনে নুসরাতের বাবা, বড় ভাই ও মামা কান্নায় ভেঙে পড়েন।

নুসরাতের চাচাতো ভাই ফরহাদ হোসেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা নুসরাতকে হত্যার বিচার চাই, আর কিছু বলার নাই। যারা এমন একটা কাজ করলো, তারা এখনও ঘুরে বেড়াচ্ছে, আমরা তাদের শাস্তি চাই।’

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের প্লাস্টিক সার্জারি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক তানভীর আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘নুসরাতকে যে বাঁচানো গেল না, কারণ হলো ৮৫ ভাগ মেজর বার্ন। এরমধ্যে ৬০ ভাগ গভীর পোড়া। তার শ্বাসতন্ত্র পোড়া আছে। কেরোসিন নিজেই টক্সিক। এটা ফুসফুস এবং ব্রেনের কার্যক্ষমতা পুরোপুরি ধ্বংস করে দেয়। এই চারটিই তার মৃত্যুর প্রধান কারণ বলা যায়। এমনিতে সুইসাইডাল বা হোমিসাইডাল দুইটার ক্ষেত্রেই ইনটেনসিভ থাকে। যেগুলো দুর্ঘটনাজনিত সেগুলোতে কোনও উদ্দেশ্য থাকে না। সেগুলো দুর্ঘটনাবশতই হয়ে যায়। যেগুলো আত্মহত্যার সেগুলোর ক্ষেত্রে সে নিজে চিন্তা করে যে, আমি কীভাবে পুড়লে মারা যাবো। আর যেগুলো খুনের বিষয় থাকে, সেখানে চিন্তা করে যে, কীভাবে পোড়ালে মারা যাবে, সে আর কিছু করতে পারবে না। সেই কারণে এই দুই ক্ষেত্রের দুর্ঘটনাগুলোর ক্ষেত্রে রোগীর অবস্থা বেশি খারাপ থাকে।

তিনি বলেন, ‘নুসরাতের ঘটনাটি আত্মহত্যাজনিত বলে আমাদের মনে হয় না। কারণ, আমরা তাকে যে রকম দেখেছি এবং তার যে অবস্থা, এতে করে এটাকে আমরা আত্মহত্যাজনিত কেস কোনোভাবেই বলবো না। তাছাড়া আপনারা মিডিয়ার মাধ্যমে জেনেছেন। আমরাও যতটুকু শুনেছি, এটা কোনোভাবেই আত্মহত্যাজনিত কোনও ঘটনা ছিল বলে আমার মনে হয় না।’

নুসরাতকে রাতে মর্গে রাখা হবে, সকালে ময়নাতদন্ত
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যাওয়া মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে আজ রাতে (বুধবার, ১০ এপ্রিল) মর্গে রাখা হবে। আগামীকাল বৃহস্পতিবার (১১ এপ্রিল) সকালে তার ময়নাতদন্ত করা হবে। এরপর তার মরদেহ ফেনীতে নিয়ে যাওয়া হবে। বলে জানিয়েছেন ঢামেক বার্ন ইউনিটের সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন।
তিনি বলেন, ‘নুসরাতকে বাঁচানোর জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হয়েছে। তবে ডিপ বার্ণ হওয়ায় প্রথম থেকেই বাঁচার সম্ভাবনা ছিল ক্ষীণ। আজকেও সিঙ্গাপুরের চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা হয়েছিল। কাল সকালে নুসরাতের পোস্টমর্টেম করা হবে। আজকে লাশ হিমঘরে রাখা হবে। পোস্টমর্টেম শেষে তাকে ফেনী নিয়ে যাওয়া হবে।’

পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হবে

নুসরাতের চাচা নুরুল হুদা শামীম বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, এখন পর্যন্ত পারিবারিক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বৃহস্পতিবার (১১ এপ্রিল) তাকে দাফন করা হবে। বাদ আসর সোনাগাজী সাবের ফাইলট হাইস্কুল মাঠে জানাজা শেষে তাকে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হবে।

গত ৬ এপ্রিল সকাল ৯টার দিকে আলিম পর্যায়ের আরবি প্রথম পত্র পরীক্ষা দিতে সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসা কেন্দ্রে যান নুসরাত। এরপর কৌশলে তাকে পাশের ভবনের ছাদে ডেকে নেওয়া হয়। সেখানে বোরকা পরা ৪/৫ ব্যক্তি তার শরীরে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। এতে তার শরীরের ৮৫ শতাংশ পুড়ে যায়। পরে তাকে উদ্ধার করে স্বজনরা প্রথমে সোনাগাজী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা তাকে ফেনী সদর হাসপাতালে পাঠান। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার পর তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে পাঠানো হয়।

প্রসঙ্গত, শনিবার (৬ এপ্রিল) সকাল ৯টার দিকে আলিম পর্যায়ের আরবি প্রথম পত্র পরীক্ষা দিতে সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসা কেন্দ্রে যান ওই ছাত্রী। এরপর কৌশলে তাকে পাশের ভবনের ছাদে ডেকে নেওয়া হয়। সেখানে বোরকা পরা ৪/৫ ব্যক্তি ওই ছাত্রীর শরীরে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। এতে তার শরীরের ৮৫ শতাংশ পুড়ে যায়। পরে ওই ছাত্রীকে উদ্ধার করে স্বজনরা প্রথমে সোনাগাজী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা তাকে ফেনী সদর হাসপাতালে পাঠান। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়ার পর তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে পাঠানো হয়।

ঢামেক বার্ন ইউনিটে লাইফ সাপোর্টে থাকা ওই ছাত্রীর ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান বলেন, শনিবার সকালে তার বোনের আরবি প্রথম পত্রের পরীক্ষা ছিল। তাকে পরীক্ষাকেন্দ্রে নিয়ে যান তিনি। তবে কেন্দ্রের প্রধান ফটকে নোমানকে আটকে দেন নিরাপত্তাকর্মী মোস্তফা। এরপর তার বোন একাই হেঁটে কেন্দ্রে প্রবেশ করেন। এ সময় নোমান কেন্দ্রে থেকে একটু দূরে চলে আসেন। এর ১৫-২০ মিনিট পরই মোবাইল ফোনে তিনি তার বোনের অগ্নিদগ্ধের খবর পান। ফের কেন্দ্রে ছুটে গিয়ে বোনকে দগ্ধ অবস্থায় দেখতে পান তিনি।

মৃত্যুর খবরে কান্নায় ভেঙে পড়েন নুসরাতের বাবা
মৃত্যুর খবরে কান্নায় ভেঙে পড়েন নুসরাতের বাবা

উল্লেখ্য, ভুক্তভোগী মাদ্রাসাছাত্রী সোনাগাজী পৌরসভার উত্তর চরছান্দিয়া গ্রামের মাওলানা একেএম মানিকের মেয়ে। অভিযোগ আছে, সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলা এর আগে ওই ছাত্রীকে যৌন নিপীড়ন করে। এ কারণে গত ২৭ মার্চ অধ্যক্ষকে আটক করে পুলিশ। এ ঘটনায় মেয়েটির মা শিরিন আক্তার বাদী হয়ে সোনাগাজী থানায় মামলা করেন। ওই মামলায় অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলা বর্তমানে ফেনী কারাগারে আছেন।

এদিকে, সোমবার (৮ এপ্রিল) দগ্ধ মাদ্রাসাছাত্রীকে উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে পাঠানোর নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে তার সর্বশেষ স্বাস্থ্যের অবস্থা জানিয়ে কাগজপত্র পাঠানো হয়। মঙ্গলবার সকালে সেখানকার চিকিৎসকদের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে কথা বলেন ডা. সামন্তলাল সেন। পরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘মেয়েটির শারীরিক যে অবস্থা তাতে পাঁচ ঘণ্টা ফ্লাই করা খুবই রিস্কি বলে মনে করছেন সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসকরা। তাই এই মুহূর্তে মেয়েটিকে সিঙ্গাপুরে নেওয়া সম্ভব না।’

মামলা দায়ের

মাদ্রাসাছাত্রীকে পুড়িয়ে হত্যাচেষ্টার ঘটনার তিনদিন পর থানায় মামলা হয়েছে। সোমবার (৮ এপ্রিল) বিকালে সোনাগাজী মডেল থানায় মামলাটি করেন ভিকটিমের বড় ভাই মাহমুদুল হাসান। মামলায় মুখোশধারী চারজন এবং তাদের সহযোগীদের আসামি করা হয়। এ ঘটনায় জড়িত সন্দেহে এ পর্যন্ত মোট আটজনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।

আরও পড়তে পারেন